পৃথিবীর কারো পক্ষেই বোধহয় চড় মেরে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসানো সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হতো তবে এই মুহূর্তে আমার বাবা আমার মাকে যে চড় দিয়েছেন তাতে পাঁচ আঙ্গুলেরই দাগ বসার কথা। কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখলাম মায়ের গালে পাঁচ আঙ্গুল নয়, দাগ বসেছে আড়াই আঙ্গুলের। অনামিকা অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। আমার মা ফর্সা মানুষ। গালের মধ্যে লালচে দাগ পরিষ্কার হয়ে ভেসে আছে।
মায়ের অপরাধ গুরুতর। বাবা চা দিতে বলেছিলেন। মা চা দিতে দেরি করেছেন। বাবা দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। মা গলা উচু করে বললেন, বলার সাথে সাথে জগতের কিছু হয় না। অপেক্ষা করতে হয়।
বলার সাথে সাথে বাবা মায়ের কাছে গেলেন। শার্টের হাতা গুটালেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারলেন।
কেবল চড় মেরেই ক্ষান্ত দিলেন না। গলা ফাটিয়ে বললেন "খানকি মাগি"।
পুরো ঘটনা ঘটতে সময় লাগল ১২ সেকেন্ড। আমি দেয়াল ঘড়ি দেখেছি। আশ্চর্যজনকভাবে এই ঘটনার কোন প্রভাব পরের মিনিটে থাকল না। সব কিছু এমন ভাবে ঘটতে থাকল যেন একটু আগে কিছুই হয় নি। বাবা চড় দিয়েই সোফার উপর বসলেন। রিমোট ঘেঁটে খেলার চ্যানেল খুঁজতে থাকলেন। মা এত বড় চড় খেয়ে গালে একবার হাতও দিলেন না। চায়ের কাপে আড়াই চামচ চিনি দিলেন। বাবা চিনি বেশি খান।
বাব চা হাতে নিয়ে আমাকে কাছে ডাকলেন । আমি ধীর পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বাবা বললেন, পড়ালেখা কেমন হয়?
আমি আস্তে করে বললাম, কিনখা গিমা।
বাবা বললেন, কি বললি?
আমি বললাম, কিছু না বাবা। একজন বিজ্ঞানীর নাম মুখস্ত করছিলাম। জাপানি বিজ্ঞানী।
বাবা বললেন, ইনি কি আবিষ্কার করেছেন?
আমি বললাম, ইনি মানুষকে দ্রুততম সময়ে মারার বিষ আবিষ্কার করেন।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, বিষ আবিষ্কার করা বিজ্ঞানীর নাম এখন পড়ায়! দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হতে দেরি নাই।
- বাবা যাই?
- যাও। পড়ালেখা করো।
আমার বয়স ১৯। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি বাবা মাকে ভয়ানক সব গালি দেন। গালিগুলো আমার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে। মাথা থেকে গালি বের করার অভিনব এক পদ্ধতি আমি বের করলাম। বাবা যে গালি দেন সেই শব্দ উল্টো করে আমি উচ্চারণ করতে থাকি। তারপর উল্টো শব্দ নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। মাথা হালকা হয়।
গিমা নামে কিছু বোধহয় পৃথিবীতে নেই। লিমা বলে একটা শব্দ আছে। পেরুর রাজধানী। আমি আমার টেবিলে এসে বিড়বিড় করতে থাকলাম, পেরুর রাজধানী লিমা, তার পাশের দেশ চিলির রাজধানী সান্টিয়াগো...
মা আমার ঘরে আসলেন। মুখ নিচু করে বসে বললেন, তোর পরিক্ষা কবে?
- কোন পরিক্ষা?
- ইন্টার পরিক্ষা।
- সেটা তো আরো ৬ মাস পর।
- তাড়াতাড়ি পাশ কর।
- পাশ করলে কি হবে মা?
- কিছু হবে না। এমনিই বললাম পাশ কর।
মা চলে গেলেন। আমি জানি পাশ করলে কি হবে। মা ভরসা খুঁজছেন। তিনি ভাবছেন আমি ইন্টার পাশ করলেই বোধহয় আহামরি কিছু হয়ে যাবে। বাবা নামের বস্তু শুধরে যাবে। কিন্তু আমি জানি এটা অসম্ভব।
জন্মের পর থেকে আমার একটা ধারণা পাকা পোক্ত হয় যে বাবা নামের মানুষেরা এমনই হয়। তারা রাগী হয়। তারা মায়েদের গায়ে যে কোন সময় হাত তোলার অধিকার রাখে। যে কোন ধরণের গালি তাদের জন্য বৈধ।
একটু বড় হয়ে বুঝতে পারলাম সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সত্য নয়। আমার কোন বন্ধু সার্কেল ছিল না। তিন বছর ধরে ছোট্ট একটা সার্কেল হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখেছি আমার বন্ধুদের বাবা মায়েদের মধ্যে এ রকম সম্পর্ক নেই। আমার বন্ধুদের বাবা মায়েরা এক সাথে বসে গল্প করে। তারা হাসাহাসি করে। আমার বাবা মা কোন দি এক সাথে বসে হাসাহাসি করে নি।
তারপর একদিন সাহস করে মা কে জিজ্ঞেস করলাম, মা বাবা এমন কেন?
মা বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, সব আমার কপাল।
আমি বললাম, কপালের দোষ বলে কিছু নাই মা। সব কিছুরই একটা না একটা কারণ থাকে। কারণ বলো?
মা আমাকে অবাক করে দিয়ে ঠাশ করে আমার গালে চড় মারলেন।চড় মেরেই মা চলে গেলেন। চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। মা আমাকে চড় মারলেন কেন?
সে দিন প্রথম বুঝতে পারলাম চড় খেলে কেমন লাগে। আমার মা দিনের পর দিন এই চড় খেয়ে যাচ্ছেন । সহ্য করছেন কিভাবে?
আমি ম্যাথ বই বের করলাম। খাতা খোলার সময়ই আমার কানে একটা একটা শব্দ আসল। আমি সাথে সাথে বিড়বিড় করতে লাগলাম, নিরামাতচু, নিরামাতচু......
আমার পড়ালেখা ব্যাপারে বাবার কোন আগ্রহ নেই। আমার পড়ালেখার খবর নেয়া ব্যাপারে বাবার একটা রুটিন আছে। তিনি যখনই মাকে লাথি বা চড় দেন তার পরপরই আমাকে ডেকে নিয়ে আমার পড়ার খবর নেন। এই কাজটা কেন করেন কে জানে।
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আবিষ্কার করলাম মায়ের গলা খালি। গতকাল পর্যন্ত এখানে একটা স্বর্ণের চেইন দেখা গিয়েছে। চেইন কোথায় বলার আগেই মনে পড়ল গতকালকে আমার কোচিং এ তিন মাসের বেতন দিতে হয়েছে। আমার পড়ার খরচ কোথা থেকে আসে তার একটা ধারণা এক দিন পর পাওয়া গেল।
মাকে মার খেতে দেখে আমার যে অনুভূতি হয় নি মায়ের গলা খালি দেখে তার চেয়ে বেশি কষ্ট লাগল। বারবার মনে হতে থাকল কি যেন নেই, কি যেন নেই। আমি পরোটা প্লেটে রেখে বললাম ,মা তোমার গলার চেইন কোথায়?
মা বললেন, তোর জানতে হবে না।
আমি বললাম, আমার জানতে হবে মা। বলো কোথায়?
মা বললেন, চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যা।
আমি জোর গলায় বললাম, বলতেই হবে মা।
মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমার ১৯ বছর জীবনে আমি মায়ের সাথে এত উচু গলায় কথা বলি নি।
মা বললেন, তুই এমন করে কথা বলছিস কেন?
আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, আমি এখন থেকে এভাবেই বলব।
মা বললেন, কেন বলবি?
- কারণ আমি বড় হয়েছি।
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুই অনেক আগেই বড় হয়েছিস। বড় হওয়ার কথা এত দিন পর জানলি? আফসোস!
আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ভাঙা গলায় বললাম, মা তুমি এই লোকটার সংসার কেন করছো?
মা শূন্য দৃষ্টিতে সিলিঙের দিকে তাকালেন। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর হঠাত করেই ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলেন।
মায়ের চোখের পানির কয়েক ফোঁটা আমার হাতে পড়ল। আমার হাত কেঁপে উঠল। অশ্রু এমন হয়? হাতে পড়ার পর মনে হয় গরম। তারপর পরই শিতল একটা অনুভূতি। শরীর কাপিয়ে দেয়ার মতো।
মা ভাঙা গলায় বললেন, কত দিন পর আমি কাঁদছি জানিস? সাড়ে সাত বছর পর। আমি কান্না ভুলে গিয়েছিলাম। তুই এত দিন পর মনে করিয়ে দিলি।
আমি বললাম, আমি দুঃখিত মা।
মা বললেন, আমি দুঃখ পাইনি। আমি আশা করেছিলাম তুই কোন একদিন আমাকে আবার কান্না মনে করিয়ে দিবি। আমি কত কাল ধরে অপেক্ষা করছি। কবে তুই আমাকে জড়িয়ে ধরবি। এত দিন পর বুঝতে শিখলি?
আমার চোখ ভিজে উঠল। আমার জগত ক্ষুদ্র ছিল। প্রতিবাদের ভাষা আমার অজানা। এত দিন ধরে আমার কাছে অন্যায়টাই রীতি। যা দেখছি সেটাকেই আমি স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছিলাম। আমার বাবা আমাকে অদ্ভুত এক সার্কাসের হাতি বানিয়ে রেখেছেন।
আমি বললাম, মা কেন তুমি এখানে আঁকড়ে পড়ে আছো?
মা নির্বিকার গলায় বললেন, তোর জন্য।
আমি বললাম, আমার জন্য কেন পড়ে থাকতে হবে?
মা বললেন, নারীর জীবনে কয়েকটা শিকল থাকে। ভালবাসার শিকল, সংসারের শিকল, সন্তানের শিকল। অনেক নারী ভালবাসার শিকলটাই ভাঙ্গতে পারে না। অদ্ভুত সব ভালবাসায় জড়িয়ে যায়। অসভ্য সামির ভালবাসা, শ্বশুর বাড়ির ভালোবাসা। আমি এই শিকল কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। কারণ এই শিকল আমার পায়ে লাগেই নি। সংসারের শিকলও কাটিয়ে উঠলাম এক সময়। সংসারের হাড়ি পাতিল থেকে মুক্তি চাইলে লাগলাম। খাট পালঙ্ক, ইট- কাঠ সব কিছুই যেন আমাকে বলতে লাগল... পালা এখান থেকে। কিন্তু আমি সর্বশেষ শিকলে আটকে গেলাম।
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। তারমানে মায়ের এই পরিণতির জন্য আমি নিজেই দায়ী?
আমার কারণেই মায়ের এমন অস্বাভাবিক জীবন?
মা আবার বলতে লাগলেন, বিয়ের পরের বছরেই তোর জন্ম হলো। আমি সেই যে আটকে গেলাম, আর নড়তে পারলাম না। মনে হলো তুই একটু বড় হয়ে হাঁটতে খেতে শিখলেই পালিয়ে যাব। তুই বড় হলি। আমি যেতে পারলাম না। মনে হলো আরেকটু বড় হ। তারপর আরেকটু... এভাবেই এখনো।আমার গলার স্বর আটকে গেল। এই সহজ ব্যাপারটা এত দিন ধরে বুঝতে পারি নি। মায়ের উপর আমার বরং উল্টো অভিমান ছিল। মা কেন এখানে পড়ে থাকবে? কেন আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না? এখানে কি এমন আছে?
আমি মাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরলাম।
মা শরীর কাঁপিয়ে ফিসফিস করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার বাবা অনেক বার চেষ্টা করেছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি যাই নি। মনে হচ্ছিল এমন কোন একদিন আসবে যখন তুই আমাকে জড়িয়ে ধরবি। আমার আর এই জীবনে চাওয়ার কিছু নেই।
:
:
রাত সাড়ে নয়টা।
বাবা অফিস থেকে ফিরেছেন ২০ মিনিট আগে। তাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ঘরে এসেই তিনি চিৎকার করলেন, ১৫ মিনিটের মধ্যে টেবিলের মধ্যে খাবার চাই। ১ মিনিট দেরি হলে চামড়া রাখব না।
১৫ মিনিটের আগেই খাবার টেবিলে পৌঁছে গেল। বাবার সাথে বসলে আমার খাওয়া হয় না। কেমন একটা অরুচি চেপে ধরে।
তবুও অনেক সময়ই খেতে হয়। আজকে বাবা ডেকেছেন।
বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পড়ালেখা কেমন চলে?
আমি চমকে গেলাম। আজকে তো মায়ের গায়ে হাত তুলেন নি। তবে পড়ালেখার কথা কেন তুললেন?
বাবা আবার জিজ্ঞেস করলেন, কেমন চলে?
আমি বললাম, জি ভালো।
- গুড। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। শুনলে খারাপ লাগতে পারে। তাও বলা দরকার।
- বলুন।
- তোমার আর কোন ভাই বোন নেই। ঘর খালি খালি লাগে। শীঘ্রই তোমার আরেকজন মা ঘরে আসবে। তোমার ভাই বোন দরকার। আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম।
আমার গলায় ভাত আটকে গেল। আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চেহারা ভাবলেশহীন। সেখানে কোন অনুভূতির চিহ্নও নেই!
মা আমার ঘরে আসলেন।
মায়ের চোখে ভরসা হারানো দৃষ্টি। পা এলোমেলো করে হাঁটছেন। আমার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর টেবিলে মাথা রেখে বললেন, অনেক চেষ্টা করলাম। আর পারলাম না।
আমি বোকার মতো বললাম, কি পারলেন না?
- তোর ২য় মায়ের আগমন রোধ।
- কবে থেকে চেষ্টা করছো?
- ১৭ বছর ধরে?
- মানে?
- তোর বাবা বিয়ের তিন বছরের মাথাতেই আবার বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমি বাধা দিয়েছি। আমার উপর অত্যাচারের এটাই একমাত্র কারণ।
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।
মা বললেন, তুই হয়তো ভাবতে পারিস আমি সতিন আটকানোর জন্য চেষ্টা করেছি। আসলে সেটা না। আমি তোর সৎ মাকে আটকানোর চেষ্টা করেছি। আরেকটা মানুষ পরিবারে আসলে তোর কি অবস্থা হবে এটা আমি কখনোই ভাবতে পারি নি।
আমার কান্না পেতে লাগল। সব কিছুর পেছনে তবে আমিই দায়ী। আমার কারণেই মায়ের এই অন্ধকার জীবন। আমিই তবে অভিশপ্ত।
আমি আস্তে করে বললাম, এমন হলো কিভাবে?
মা অনেকক্ষণ কিছু বললেন না। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, কিছু মানুষ সারা জীবন পুরুষ থেকে যায়। এরা মানুষ হয় না। তোর বাবা সে রকম একজন মানুষ। সে পুরুষের গণ্ডি থেকে বেরুতে পারে নি। তোর আর কোন ভাই বোন নেই। এর দায় আমার। আমি চাইনি আমি আরেকটা শিকল পায়ে লাগাই। কিভাবে কি হয়েছে সেটা তুই এখন বুঝবি না, বুঝবি আরো কয়ে বছর পর।
মা এবার খানিকটা হাসি মুখে বললেন, কোন মেয়েকে পছন্দ করিস?
আমি বললাম, না।
মা হাসি বিস্তৃত করে বললেন, মিথ্যা বলবি না। জান্নাত নামের এক মেয়ের নাম তোর খাতায় লেখা। তাকে ভালো লাগে?
আমি মুখ নিচু করে বললাম, হাঁ।
মা আমার মাথা তার বুকে চেপে ধরে বললেন, আমার সারা জীবনের যুদ্ধ ছিল তোকে তোর বাবার ডিএনএ থেকে মুক্ত করা। পেরেছি কিনা জানি না। তুই কতটা পুরুষ হয়েছিস আর কতটা মানুষ হয়েছিস সেটা সময়ই বলে দেবে।
আমি চুপ করে বসে রইলাম।
মা আবার বললেন, একটা পরিষ্কার কথা বলতে চাই। পৃথিবীর সব পুরুষ তোর বাবার মতো না। সবাই এক এই ধারণা নিয়ে বড় হলে সমস্যায় পড়বি। যে মেয়েটাকে বিয়ে করবি সে যেন আমার জীবন না পায়।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মাকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। একদম অন্যরকম। এই চেহারা আমি আগে কখনো দেখি নি।
বাবা বিয়ে করলেন।
কঠিন চেহারার এক মধ্যবয়সী মহিলা আমাদের বাসায় প্রবেশ করল। বাসায় ঢুকেই মহিলা বলল, ঘরে এসি নাই? এই গরমে কেমনে থাকা যায়?
বাবা চিৎকার করে মাকে বললেন, ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দাও।
মা ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিলেন।
স্টোর রুমের মতো একটা রুমে মায়ের থাকার ব্যবস্থা হলো। মা সুন্দর করে সেই রুম পরিষ্কার করলেন। বিছানা পাতলেন। ঘরে এয়ার ফ্রেশনার দিলেন। সব শেষে রাত তিনটার সময় বিষ খেয়ে বসলেন।
মায়ের মরার চেষ্টা সফল হয় নি।
বিষ খাওয়ার ব্যাপারটা আমি টের পেয়ে যাই। ঐ ঘর থেকে অস্বাভাবিক ভাবে গলার আওয়াজ আসছিল। আমি দরজা খুলেই দেখলাম মা কাতরাচ্ছেন। পরে কিভাবে কি করেছি জানি না। কোন শক্তিবলে মাকে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছি বলতে পারব না। স্টমাক ওয়াশ নামক এক যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া শেষে মা বেঁচে গেলেন।
ফেরার পথে বললেন, আমি ভেবেছি তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। এবার পালাতে আপত্তি নেই। তুই আমাকে বাঁচানোর মতো বড় হয়ে গেছিস বুঝতে পারি নি।
আমি আস্তে করে বললাম, আমি এত বড় হয়েছি এটা আমিও বুঝতে পারি নি মা।
:
পরদিন বাবা আমাকে ডাকলেন।
মধ্যবয়সী সেই মহিলা বাবার পাশে বসা। মা তার নতুন ঘরে শুয়ে আছেন।
বাবা বললেন, তোমার মা মরতে গেছে কেন?
আমি বললাম, দুঃখে।
- কিসের দুঃখে?
- আপনি বিয়ে করেছেন সেই দুঃখে।
- এখানে দুঃখ পাওয়ার কি আছে? সে আমাকে সন্তান দিতে পারবে না। তার জরায়ু অপারেশন করা। আমি কি সন্তানের জন্য বসে থাকব।
- ঠিক।
- নতুন একটা মানুষ ঘরে এসেছে। সে দিনই তাকে মরতে হবে? আমাড় ইজ্জত রাখল?
- না।
- অসুস্থ না হলে কি মাইরটাই না দিতাম!
আমি বললাম, রনিরামাতচু তপু।
বাবা বললেন এটা কি?
আমি বললাম, এটা একজন বিজ্ঞানীর নাম।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, বিজ্ঞানীর নাম তপু? কোন দেশি? আর তুমি এখানে বিজ্ঞানীর নাম টানছ কেন?
আমি বললাম, এটা বাংলাদেশী বিজ্ঞানী। সে আধুনিক পদ্ধতিতে চড় মারা আবিষ্কার করেছে।
বাবা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তারচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে মধ্যবয়সী মহিলা। বাবা বললেন, কি উল্টাপাল্টা বলছো?
আমি খুব শান্ত গলায় বললাম, বাবা আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
বাবা বেশ অবাক হয়ে বললেন, বলো।
আমি বললাম, গত রাতে মা বিষ খাওয়ার কারণে একটা লাভ হয়েছে। মাকে নিয়ে আমার একাই হাসপাতালে যেতে হয়েছে। আপনাদের রুম বন্ধ ছিল। আপনাদের সাহায্য ছাড়াই আমি মাকে বাঁচাতে পেরেছি। তারপরই একটা জিনিষ বুঝতে পারলাম আমার গায়ে শক্তি আছে, মাথায় বুদ্ধিও আছে।
মাকে নিয়ে ঘরে আসার পরপরই আরেকটা চিন্তা মাথায় আসল। আমি যদি একজনকে বাঁচাতে পারি তবে আরেকজনকে কেন মারতে পারব না?
বাবা মুখ শক্ত করে বললেন, কি বলতে চাও?
আমি হাসি মুখে বললাম, সামান্যই। ধরুন এই একটা ছুরি। আপনারা স্বামী স্ত্রী রাতে ঘুমালেন। আমি আস্তে করে আপনাদের রুমে ঢুকলাম। সকালে দেখা গেল দুইজনেই গলা কাঁটা। এমনটা হতে পারে না?
বাবা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন। তার পাশে বসা মহিলা এর থেকে বেশি ভয় পাচ্ছে। আমি মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে ঐ মহিলার দিকে তাকালাম।
তারপর বললাম, ছোট মা আপনিই বলুন এটা হতে পারে না?
মহিলা চুপসে গেল।
আমি বললাম, ছোট মা, আপনাকে যদি আমি "কিনখা গিমা" বলে ডাকি আপনার আপত্তি আছে?
মহিলা মিনমিন করে বলল, কিনখা গিমা কি?
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, রনিরামাতচু তপু, আপনি একটু উনাকে শব্দটা উল্টো করে বুঝিয়ে দিন না।
বাবা এবার বুঝতে পারলেন। ভালো মতেই ধরতে পারলেন আমি কি বলছি। তাঁর চেহারা পুরোপুরি ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল।
পৃথিবীর অমানুষগুলো এত ভীতু হয়?স্যালাইন ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ছে।
মা লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখের কোণ গলে পানি বের হচ্ছে।
আমি আস্তে করে বললাম, মা!
মা বললেন, বল।
- লোকটা ভীতু। খুন করে ফেলি?
- ছি! সে তোর বাবা।
- কিন্তু সে অমানুষ।
- মানুষ হলেও তো হতে পারে।
- এখনো আশা করো?
- তোর জন্য কত বছর আশা করে অপেক্ষা করেছি, জানিস?
আমি শুয়ে থাকা মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মায়ের শরীর জুড়ে একটা গন্ধ। এই গন্ধের কোন ধর্ম নেই। এই গন্ধের কোন শ্রেণী নেই। অদ্ভুত মায়াময় এক সম্মোহনী শক্তি আছে এই গন্ধের।
এই গন্ধ শুকে একশ বার বেঁচে থাকা যায়, একশবার মরে যাওয়া যায়। একশ জনকে মারা যায়, একশ জনকে বাঁচানো যায়।
আমি ফিসফিস করে বললাম, মা!
- বল...
- মা...
- বল...
- মা...
- আশ্চর্য!
- মা...
- বলছিস না কেন?
- মা...
আমি বলতেই থাকলাম, বলতেই থাকলাম
মায়ের অপরাধ গুরুতর। বাবা চা দিতে বলেছিলেন। মা চা দিতে দেরি করেছেন। বাবা দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। মা গলা উচু করে বললেন, বলার সাথে সাথে জগতের কিছু হয় না। অপেক্ষা করতে হয়।
বলার সাথে সাথে বাবা মায়ের কাছে গেলেন। শার্টের হাতা গুটালেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারলেন।
কেবল চড় মেরেই ক্ষান্ত দিলেন না। গলা ফাটিয়ে বললেন "খানকি মাগি"।
পুরো ঘটনা ঘটতে সময় লাগল ১২ সেকেন্ড। আমি দেয়াল ঘড়ি দেখেছি। আশ্চর্যজনকভাবে এই ঘটনার কোন প্রভাব পরের মিনিটে থাকল না। সব কিছু এমন ভাবে ঘটতে থাকল যেন একটু আগে কিছুই হয় নি। বাবা চড় দিয়েই সোফার উপর বসলেন। রিমোট ঘেঁটে খেলার চ্যানেল খুঁজতে থাকলেন। মা এত বড় চড় খেয়ে গালে একবার হাতও দিলেন না। চায়ের কাপে আড়াই চামচ চিনি দিলেন। বাবা চিনি বেশি খান।
বাব চা হাতে নিয়ে আমাকে কাছে ডাকলেন । আমি ধীর পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বাবা বললেন, পড়ালেখা কেমন হয়?
আমি আস্তে করে বললাম, কিনখা গিমা।
বাবা বললেন, কি বললি?
আমি বললাম, কিছু না বাবা। একজন বিজ্ঞানীর নাম মুখস্ত করছিলাম। জাপানি বিজ্ঞানী।
বাবা বললেন, ইনি কি আবিষ্কার করেছেন?
আমি বললাম, ইনি মানুষকে দ্রুততম সময়ে মারার বিষ আবিষ্কার করেন।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, বিষ আবিষ্কার করা বিজ্ঞানীর নাম এখন পড়ায়! দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হতে দেরি নাই।
- বাবা যাই?
- যাও। পড়ালেখা করো।
আমার বয়স ১৯। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি বাবা মাকে ভয়ানক সব গালি দেন। গালিগুলো আমার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে। মাথা থেকে গালি বের করার অভিনব এক পদ্ধতি আমি বের করলাম। বাবা যে গালি দেন সেই শব্দ উল্টো করে আমি উচ্চারণ করতে থাকি। তারপর উল্টো শব্দ নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। মাথা হালকা হয়।
গিমা নামে কিছু বোধহয় পৃথিবীতে নেই। লিমা বলে একটা শব্দ আছে। পেরুর রাজধানী। আমি আমার টেবিলে এসে বিড়বিড় করতে থাকলাম, পেরুর রাজধানী লিমা, তার পাশের দেশ চিলির রাজধানী সান্টিয়াগো...
মা আমার ঘরে আসলেন। মুখ নিচু করে বসে বললেন, তোর পরিক্ষা কবে?
- কোন পরিক্ষা?
- ইন্টার পরিক্ষা।
- সেটা তো আরো ৬ মাস পর।
- তাড়াতাড়ি পাশ কর।
- পাশ করলে কি হবে মা?
- কিছু হবে না। এমনিই বললাম পাশ কর।
মা চলে গেলেন। আমি জানি পাশ করলে কি হবে। মা ভরসা খুঁজছেন। তিনি ভাবছেন আমি ইন্টার পাশ করলেই বোধহয় আহামরি কিছু হয়ে যাবে। বাবা নামের বস্তু শুধরে যাবে। কিন্তু আমি জানি এটা অসম্ভব।
জন্মের পর থেকে আমার একটা ধারণা পাকা পোক্ত হয় যে বাবা নামের মানুষেরা এমনই হয়। তারা রাগী হয়। তারা মায়েদের গায়ে যে কোন সময় হাত তোলার অধিকার রাখে। যে কোন ধরণের গালি তাদের জন্য বৈধ।
একটু বড় হয়ে বুঝতে পারলাম সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সত্য নয়। আমার কোন বন্ধু সার্কেল ছিল না। তিন বছর ধরে ছোট্ট একটা সার্কেল হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখেছি আমার বন্ধুদের বাবা মায়েদের মধ্যে এ রকম সম্পর্ক নেই। আমার বন্ধুদের বাবা মায়েরা এক সাথে বসে গল্প করে। তারা হাসাহাসি করে। আমার বাবা মা কোন দি এক সাথে বসে হাসাহাসি করে নি।
তারপর একদিন সাহস করে মা কে জিজ্ঞেস করলাম, মা বাবা এমন কেন?
মা বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, সব আমার কপাল।
আমি বললাম, কপালের দোষ বলে কিছু নাই মা। সব কিছুরই একটা না একটা কারণ থাকে। কারণ বলো?
মা আমাকে অবাক করে দিয়ে ঠাশ করে আমার গালে চড় মারলেন।চড় মেরেই মা চলে গেলেন। চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। মা আমাকে চড় মারলেন কেন?
সে দিন প্রথম বুঝতে পারলাম চড় খেলে কেমন লাগে। আমার মা দিনের পর দিন এই চড় খেয়ে যাচ্ছেন । সহ্য করছেন কিভাবে?
আমি ম্যাথ বই বের করলাম। খাতা খোলার সময়ই আমার কানে একটা একটা শব্দ আসল। আমি সাথে সাথে বিড়বিড় করতে লাগলাম, নিরামাতচু, নিরামাতচু......
আমার পড়ালেখা ব্যাপারে বাবার কোন আগ্রহ নেই। আমার পড়ালেখার খবর নেয়া ব্যাপারে বাবার একটা রুটিন আছে। তিনি যখনই মাকে লাথি বা চড় দেন তার পরপরই আমাকে ডেকে নিয়ে আমার পড়ার খবর নেন। এই কাজটা কেন করেন কে জানে।
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আবিষ্কার করলাম মায়ের গলা খালি। গতকাল পর্যন্ত এখানে একটা স্বর্ণের চেইন দেখা গিয়েছে। চেইন কোথায় বলার আগেই মনে পড়ল গতকালকে আমার কোচিং এ তিন মাসের বেতন দিতে হয়েছে। আমার পড়ার খরচ কোথা থেকে আসে তার একটা ধারণা এক দিন পর পাওয়া গেল।
মাকে মার খেতে দেখে আমার যে অনুভূতি হয় নি মায়ের গলা খালি দেখে তার চেয়ে বেশি কষ্ট লাগল। বারবার মনে হতে থাকল কি যেন নেই, কি যেন নেই। আমি পরোটা প্লেটে রেখে বললাম ,মা তোমার গলার চেইন কোথায়?
মা বললেন, তোর জানতে হবে না।
আমি বললাম, আমার জানতে হবে মা। বলো কোথায়?
মা বললেন, চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যা।
আমি জোর গলায় বললাম, বলতেই হবে মা।
মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমার ১৯ বছর জীবনে আমি মায়ের সাথে এত উচু গলায় কথা বলি নি।
মা বললেন, তুই এমন করে কথা বলছিস কেন?
আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, আমি এখন থেকে এভাবেই বলব।
মা বললেন, কেন বলবি?
- কারণ আমি বড় হয়েছি।
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুই অনেক আগেই বড় হয়েছিস। বড় হওয়ার কথা এত দিন পর জানলি? আফসোস!
আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ভাঙা গলায় বললাম, মা তুমি এই লোকটার সংসার কেন করছো?
মা শূন্য দৃষ্টিতে সিলিঙের দিকে তাকালেন। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর হঠাত করেই ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলেন।
মায়ের চোখের পানির কয়েক ফোঁটা আমার হাতে পড়ল। আমার হাত কেঁপে উঠল। অশ্রু এমন হয়? হাতে পড়ার পর মনে হয় গরম। তারপর পরই শিতল একটা অনুভূতি। শরীর কাপিয়ে দেয়ার মতো।
মা ভাঙা গলায় বললেন, কত দিন পর আমি কাঁদছি জানিস? সাড়ে সাত বছর পর। আমি কান্না ভুলে গিয়েছিলাম। তুই এত দিন পর মনে করিয়ে দিলি।
আমি বললাম, আমি দুঃখিত মা।
মা বললেন, আমি দুঃখ পাইনি। আমি আশা করেছিলাম তুই কোন একদিন আমাকে আবার কান্না মনে করিয়ে দিবি। আমি কত কাল ধরে অপেক্ষা করছি। কবে তুই আমাকে জড়িয়ে ধরবি। এত দিন পর বুঝতে শিখলি?
আমার চোখ ভিজে উঠল। আমার জগত ক্ষুদ্র ছিল। প্রতিবাদের ভাষা আমার অজানা। এত দিন ধরে আমার কাছে অন্যায়টাই রীতি। যা দেখছি সেটাকেই আমি স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছিলাম। আমার বাবা আমাকে অদ্ভুত এক সার্কাসের হাতি বানিয়ে রেখেছেন।
আমি বললাম, মা কেন তুমি এখানে আঁকড়ে পড়ে আছো?
মা নির্বিকার গলায় বললেন, তোর জন্য।
আমি বললাম, আমার জন্য কেন পড়ে থাকতে হবে?
মা বললেন, নারীর জীবনে কয়েকটা শিকল থাকে। ভালবাসার শিকল, সংসারের শিকল, সন্তানের শিকল। অনেক নারী ভালবাসার শিকলটাই ভাঙ্গতে পারে না। অদ্ভুত সব ভালবাসায় জড়িয়ে যায়। অসভ্য সামির ভালবাসা, শ্বশুর বাড়ির ভালোবাসা। আমি এই শিকল কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। কারণ এই শিকল আমার পায়ে লাগেই নি। সংসারের শিকলও কাটিয়ে উঠলাম এক সময়। সংসারের হাড়ি পাতিল থেকে মুক্তি চাইলে লাগলাম। খাট পালঙ্ক, ইট- কাঠ সব কিছুই যেন আমাকে বলতে লাগল... পালা এখান থেকে। কিন্তু আমি সর্বশেষ শিকলে আটকে গেলাম।
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। তারমানে মায়ের এই পরিণতির জন্য আমি নিজেই দায়ী?
আমার কারণেই মায়ের এমন অস্বাভাবিক জীবন?
মা আবার বলতে লাগলেন, বিয়ের পরের বছরেই তোর জন্ম হলো। আমি সেই যে আটকে গেলাম, আর নড়তে পারলাম না। মনে হলো তুই একটু বড় হয়ে হাঁটতে খেতে শিখলেই পালিয়ে যাব। তুই বড় হলি। আমি যেতে পারলাম না। মনে হলো আরেকটু বড় হ। তারপর আরেকটু... এভাবেই এখনো।আমার গলার স্বর আটকে গেল। এই সহজ ব্যাপারটা এত দিন ধরে বুঝতে পারি নি। মায়ের উপর আমার বরং উল্টো অভিমান ছিল। মা কেন এখানে পড়ে থাকবে? কেন আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না? এখানে কি এমন আছে?
আমি মাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরলাম।
মা শরীর কাঁপিয়ে ফিসফিস করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার বাবা অনেক বার চেষ্টা করেছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি যাই নি। মনে হচ্ছিল এমন কোন একদিন আসবে যখন তুই আমাকে জড়িয়ে ধরবি। আমার আর এই জীবনে চাওয়ার কিছু নেই।
:
:
রাত সাড়ে নয়টা।
বাবা অফিস থেকে ফিরেছেন ২০ মিনিট আগে। তাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ঘরে এসেই তিনি চিৎকার করলেন, ১৫ মিনিটের মধ্যে টেবিলের মধ্যে খাবার চাই। ১ মিনিট দেরি হলে চামড়া রাখব না।
১৫ মিনিটের আগেই খাবার টেবিলে পৌঁছে গেল। বাবার সাথে বসলে আমার খাওয়া হয় না। কেমন একটা অরুচি চেপে ধরে।
তবুও অনেক সময়ই খেতে হয়। আজকে বাবা ডেকেছেন।
বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পড়ালেখা কেমন চলে?
আমি চমকে গেলাম। আজকে তো মায়ের গায়ে হাত তুলেন নি। তবে পড়ালেখার কথা কেন তুললেন?
বাবা আবার জিজ্ঞেস করলেন, কেমন চলে?
আমি বললাম, জি ভালো।
- গুড। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। শুনলে খারাপ লাগতে পারে। তাও বলা দরকার।
- বলুন।
- তোমার আর কোন ভাই বোন নেই। ঘর খালি খালি লাগে। শীঘ্রই তোমার আরেকজন মা ঘরে আসবে। তোমার ভাই বোন দরকার। আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম।
আমার গলায় ভাত আটকে গেল। আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চেহারা ভাবলেশহীন। সেখানে কোন অনুভূতির চিহ্নও নেই!
মা আমার ঘরে আসলেন।
মায়ের চোখে ভরসা হারানো দৃষ্টি। পা এলোমেলো করে হাঁটছেন। আমার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর টেবিলে মাথা রেখে বললেন, অনেক চেষ্টা করলাম। আর পারলাম না।
আমি বোকার মতো বললাম, কি পারলেন না?
- তোর ২য় মায়ের আগমন রোধ।
- কবে থেকে চেষ্টা করছো?
- ১৭ বছর ধরে?
- মানে?
- তোর বাবা বিয়ের তিন বছরের মাথাতেই আবার বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমি বাধা দিয়েছি। আমার উপর অত্যাচারের এটাই একমাত্র কারণ।
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।
মা বললেন, তুই হয়তো ভাবতে পারিস আমি সতিন আটকানোর জন্য চেষ্টা করেছি। আসলে সেটা না। আমি তোর সৎ মাকে আটকানোর চেষ্টা করেছি। আরেকটা মানুষ পরিবারে আসলে তোর কি অবস্থা হবে এটা আমি কখনোই ভাবতে পারি নি।
আমার কান্না পেতে লাগল। সব কিছুর পেছনে তবে আমিই দায়ী। আমার কারণেই মায়ের এই অন্ধকার জীবন। আমিই তবে অভিশপ্ত।
আমি আস্তে করে বললাম, এমন হলো কিভাবে?
মা অনেকক্ষণ কিছু বললেন না। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, কিছু মানুষ সারা জীবন পুরুষ থেকে যায়। এরা মানুষ হয় না। তোর বাবা সে রকম একজন মানুষ। সে পুরুষের গণ্ডি থেকে বেরুতে পারে নি। তোর আর কোন ভাই বোন নেই। এর দায় আমার। আমি চাইনি আমি আরেকটা শিকল পায়ে লাগাই। কিভাবে কি হয়েছে সেটা তুই এখন বুঝবি না, বুঝবি আরো কয়ে বছর পর।
মা এবার খানিকটা হাসি মুখে বললেন, কোন মেয়েকে পছন্দ করিস?
আমি বললাম, না।
মা হাসি বিস্তৃত করে বললেন, মিথ্যা বলবি না। জান্নাত নামের এক মেয়ের নাম তোর খাতায় লেখা। তাকে ভালো লাগে?
আমি মুখ নিচু করে বললাম, হাঁ।
মা আমার মাথা তার বুকে চেপে ধরে বললেন, আমার সারা জীবনের যুদ্ধ ছিল তোকে তোর বাবার ডিএনএ থেকে মুক্ত করা। পেরেছি কিনা জানি না। তুই কতটা পুরুষ হয়েছিস আর কতটা মানুষ হয়েছিস সেটা সময়ই বলে দেবে।
আমি চুপ করে বসে রইলাম।
মা আবার বললেন, একটা পরিষ্কার কথা বলতে চাই। পৃথিবীর সব পুরুষ তোর বাবার মতো না। সবাই এক এই ধারণা নিয়ে বড় হলে সমস্যায় পড়বি। যে মেয়েটাকে বিয়ে করবি সে যেন আমার জীবন না পায়।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মাকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। একদম অন্যরকম। এই চেহারা আমি আগে কখনো দেখি নি।
বাবা বিয়ে করলেন।
কঠিন চেহারার এক মধ্যবয়সী মহিলা আমাদের বাসায় প্রবেশ করল। বাসায় ঢুকেই মহিলা বলল, ঘরে এসি নাই? এই গরমে কেমনে থাকা যায়?
বাবা চিৎকার করে মাকে বললেন, ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দাও।
মা ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিলেন।
স্টোর রুমের মতো একটা রুমে মায়ের থাকার ব্যবস্থা হলো। মা সুন্দর করে সেই রুম পরিষ্কার করলেন। বিছানা পাতলেন। ঘরে এয়ার ফ্রেশনার দিলেন। সব শেষে রাত তিনটার সময় বিষ খেয়ে বসলেন।
মায়ের মরার চেষ্টা সফল হয় নি।
বিষ খাওয়ার ব্যাপারটা আমি টের পেয়ে যাই। ঐ ঘর থেকে অস্বাভাবিক ভাবে গলার আওয়াজ আসছিল। আমি দরজা খুলেই দেখলাম মা কাতরাচ্ছেন। পরে কিভাবে কি করেছি জানি না। কোন শক্তিবলে মাকে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছি বলতে পারব না। স্টমাক ওয়াশ নামক এক যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া শেষে মা বেঁচে গেলেন।
ফেরার পথে বললেন, আমি ভেবেছি তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। এবার পালাতে আপত্তি নেই। তুই আমাকে বাঁচানোর মতো বড় হয়ে গেছিস বুঝতে পারি নি।
আমি আস্তে করে বললাম, আমি এত বড় হয়েছি এটা আমিও বুঝতে পারি নি মা।
:
পরদিন বাবা আমাকে ডাকলেন।
মধ্যবয়সী সেই মহিলা বাবার পাশে বসা। মা তার নতুন ঘরে শুয়ে আছেন।
বাবা বললেন, তোমার মা মরতে গেছে কেন?
আমি বললাম, দুঃখে।
- কিসের দুঃখে?
- আপনি বিয়ে করেছেন সেই দুঃখে।
- এখানে দুঃখ পাওয়ার কি আছে? সে আমাকে সন্তান দিতে পারবে না। তার জরায়ু অপারেশন করা। আমি কি সন্তানের জন্য বসে থাকব।
- ঠিক।
- নতুন একটা মানুষ ঘরে এসেছে। সে দিনই তাকে মরতে হবে? আমাড় ইজ্জত রাখল?
- না।
- অসুস্থ না হলে কি মাইরটাই না দিতাম!
আমি বললাম, রনিরামাতচু তপু।
বাবা বললেন এটা কি?
আমি বললাম, এটা একজন বিজ্ঞানীর নাম।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, বিজ্ঞানীর নাম তপু? কোন দেশি? আর তুমি এখানে বিজ্ঞানীর নাম টানছ কেন?
আমি বললাম, এটা বাংলাদেশী বিজ্ঞানী। সে আধুনিক পদ্ধতিতে চড় মারা আবিষ্কার করেছে।
বাবা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তারচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে মধ্যবয়সী মহিলা। বাবা বললেন, কি উল্টাপাল্টা বলছো?
আমি খুব শান্ত গলায় বললাম, বাবা আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
বাবা বেশ অবাক হয়ে বললেন, বলো।
আমি বললাম, গত রাতে মা বিষ খাওয়ার কারণে একটা লাভ হয়েছে। মাকে নিয়ে আমার একাই হাসপাতালে যেতে হয়েছে। আপনাদের রুম বন্ধ ছিল। আপনাদের সাহায্য ছাড়াই আমি মাকে বাঁচাতে পেরেছি। তারপরই একটা জিনিষ বুঝতে পারলাম আমার গায়ে শক্তি আছে, মাথায় বুদ্ধিও আছে।
মাকে নিয়ে ঘরে আসার পরপরই আরেকটা চিন্তা মাথায় আসল। আমি যদি একজনকে বাঁচাতে পারি তবে আরেকজনকে কেন মারতে পারব না?
বাবা মুখ শক্ত করে বললেন, কি বলতে চাও?
আমি হাসি মুখে বললাম, সামান্যই। ধরুন এই একটা ছুরি। আপনারা স্বামী স্ত্রী রাতে ঘুমালেন। আমি আস্তে করে আপনাদের রুমে ঢুকলাম। সকালে দেখা গেল দুইজনেই গলা কাঁটা। এমনটা হতে পারে না?
বাবা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন। তার পাশে বসা মহিলা এর থেকে বেশি ভয় পাচ্ছে। আমি মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে ঐ মহিলার দিকে তাকালাম।
তারপর বললাম, ছোট মা আপনিই বলুন এটা হতে পারে না?
মহিলা চুপসে গেল।
আমি বললাম, ছোট মা, আপনাকে যদি আমি "কিনখা গিমা" বলে ডাকি আপনার আপত্তি আছে?
মহিলা মিনমিন করে বলল, কিনখা গিমা কি?
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, রনিরামাতচু তপু, আপনি একটু উনাকে শব্দটা উল্টো করে বুঝিয়ে দিন না।
বাবা এবার বুঝতে পারলেন। ভালো মতেই ধরতে পারলেন আমি কি বলছি। তাঁর চেহারা পুরোপুরি ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল।
পৃথিবীর অমানুষগুলো এত ভীতু হয়?স্যালাইন ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ছে।
মা লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখের কোণ গলে পানি বের হচ্ছে।
আমি আস্তে করে বললাম, মা!
মা বললেন, বল।
- লোকটা ভীতু। খুন করে ফেলি?
- ছি! সে তোর বাবা।
- কিন্তু সে অমানুষ।
- মানুষ হলেও তো হতে পারে।
- এখনো আশা করো?
- তোর জন্য কত বছর আশা করে অপেক্ষা করেছি, জানিস?
আমি শুয়ে থাকা মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মায়ের শরীর জুড়ে একটা গন্ধ। এই গন্ধের কোন ধর্ম নেই। এই গন্ধের কোন শ্রেণী নেই। অদ্ভুত মায়াময় এক সম্মোহনী শক্তি আছে এই গন্ধের।
এই গন্ধ শুকে একশ বার বেঁচে থাকা যায়, একশবার মরে যাওয়া যায়। একশ জনকে মারা যায়, একশ জনকে বাঁচানো যায়।
আমি ফিসফিস করে বললাম, মা!
- বল...
- মা...
- বল...
- মা...
- আশ্চর্য!
- মা...
- বলছিস না কেন?
- মা...
আমি বলতেই থাকলাম, বলতেই থাকলাম
Post a Comment