মানুষ ভাষা নির্মাণ করে। এই ভাষাই আবার বলে দেয় যারা তাকে নির্মাণ করেছে, তারা কেমন মানুষ। এ কারণেই বলা হয়, "কথা শুনলেই বুঝা যায়, মানুষটা কেমন।"
আমাদের একটা বহুল ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে, নির্বাচন। আমাদের প্রাপ্ত বয়স্ক রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা এই নির্বাচনে নামেন, এই নির্বাচন করেন, এই নির্বাচনে দাঁড়ান/খাড়ান, নির্বাচন বয়কটও করেন। এতোভাবে "নির্বাচন" শব্দটি ব্যবহৃত হয় যে, তাতে এমন মনে করা যেতেই পারে; শব্দটার ব্যবহার বা নির্বাচন ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রজনরা মন স্থির করে উঠতে পারেনি। আবার অন্য কোনো রাজনীতিও থাকতে পারে শব্দটা নিয়ে!
কেউ যদি বলেন, আমি নির্বাচন করছি, তাহলে আমাদের ধরে নেওয়ার কথা, উনি বেশ কিছু বিকল্প থেকে এক বা একাধিক কিছু বাছাই করছেন। যেমন, কেনার জন্য দশটা গাধা থেকে একটা গাধা নির্বাচন করছেন। কিন্তু যাকে নির্বাচন করা হচ্ছে, সেই গাধা বা গাধার দল যদি বলে "আমি/আমরা নির্বাচন করছি বা নির্বাচন করছি না" তাহলে বুঝতে হবে আপনি প্রকৃত গাধা বা গাধা দলের সন্ধান পেয়ে গেছেন।
আবার কেউ যদি বলে, "আমি নির্বাচনে নেমেছি", তাহলে বুঝতে হবে উনি কিছু একটা বাছাই করতে- নিচ তলায় নেমেছেন/জলে নেমেছেন/মাঠে নেমেছেন, রাস্তায় নেমেছেন ইত্যাদি। উনিই এখানে কর্তা। অথচ খেয়াল করে দেখুন, যিনি বলেন "আমি নির্বাচনে নেমেছি" প্রকৃত পক্ষে তিনি কর্তা নন। তাকে যারা বাছাই করেন তারা, মানে জনগণই এখানে কর্তার ভূমিকায়।
জনগণ হয়তো নির্বাচনে নামতে পারে, কিন্তু তারা কখনেই বলে না যে, আমি বা আমরা নির্বাচনে নেমেছি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, যে বা যারা বলেন, "আমি বা আমরা নির্বাচনে নেমেছি" তারা কথাটি ঠিক করে বলে না।
"যদি নির্বাচন হয় আমিও দাঁড়াবো, ইনশাআল্লাহ।" খুব প্রিয় পঙক্তি আমার। কিন্তু এই "নির্বাচনে দাঁড়ানোর" ব্যাপারটা কী? মানুষ নানান স্থানে বা জায়গায় দাঁড়াতে পারে। বলতে পারে, আমি মাঠে দাঁড়িয়েছি, ঘাটে দাঁড়িয়েছি, পথে দাঁড়িয়েছি। আমি কিছু একটার বিরুদ্ধে বা পক্ষেও দাঁড়াতে পারি। কিন্তু নির্বাচনে দাঁড়ানোটা কিভাবে সম্ভব? এই সোনার পাথর বাটি কিভাবে তৈরি হলো সেও এক রহস্য।
যদি নির্বাচন করা, নির্বাচনে নামা বা নির্বাচনে দাঁড়ানো- কথাগুলো যথেষ্ট শুদ্ধ বা যথাযথ না হয়, তাহলে কেন আমাদের রাজনীতির মানুষরা যুগের পর যুগ এভাবে বলে চলেছেন? এটা কি ইচ্ছাকৃত ভুল, না বুঝে করা ভুল, না কি তার বা তাদের অবচেতনে অন্য কিছু রয়েছে?
সম্ভবত, নির্বাচনের পুরো বিষয়টা আমাদের মানসে ঢুকেছে ইংরেজি "ইলেকশন"-এর সূত্র ধরে। কিন্তু এই "ইলেকশন"টা কী সে নিয়ে আমাদের পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার সুযোগ নাই। কারণ বস্তুটি আমাদের সহজাত না। যা নাই বা থাকে না তা কল্পনায় নির্মাণ করতে গেলে গোঁজামিল থাকবেই।
আমার এ কথার প্রমাণ আছে "ইলেকশন কমিশন"- এর বাংলা "নির্বাচন কমিশন" করার বা হওয়ার মধ্যে। "কমিশন" আরও রহস্যময় এক প্রপঞ্চ। এটি খায় না মাথায় দেয় তা বাংলায় এই "কমিশন" যারা নাজিল করছেন তারাও সম্ভবত ঠিক মতো বোঝেন নি। বুঝলে কমিশনের বাংলা কী হবে সেটি ঠিক করতেই প্রথম "কমিশন" বসাতেন এবং সেখান থেকেই হয়তো "কমিশন" খাওয়ার ব্যাপারটা শুরু হতো। কিন্তু এখন "কমিশন" প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। "ইলেকশন" নিয়েই বরং চিন্তা করি।
তার আগে আবার একটু স্মরণ করে নেই, বাংলায় "নির্বাচন" শব্দটার অর্থ কী? "নির্বাচন" অর্থ "বহুর মধ্য থেকে বেছে নেওয়া"। এই শব্দটির খুব চালু ইংরেজি "সিলেকশন"। আমাদের নানান রকম "সিলেকশন বোর্ড" সম্পর্কে আমরা জানি। চাকুরি পেতে হলে " সিলেকশন বোর্ড"-এর মোকাবিলা আমাদের করতে হয়। নানান রকম সিলেকশন টেস্ট বা এক্সামিনেশন আমাদের দিতে হয়। আমরা এইসবকে বলি নির্বাচনী পরীক্ষা, বাছাই পরীক্ষা ইত্যাদি। যেমন "আইএসএসবি"। ইংরেজি "সিলেকশন"ই যে বাছাই বা নির্বাচন সে নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বিধার অবকাশ নাই বললেই চলে।
এবার ভাবুন তো, ইলেকশন কমিশনের বাংলা নির্বাচন কমিশন কিভাবে বা কেন হলো? হলো, কারণ আমাদের সমাজ-রাজনীতির হর্তাকর্তারা ইলেকশন বলতে নির্বাচনটাই বোঝেন। তারাই আসলে নির্বাচন করেন। তারাই বাছাই করেন, অনুগতবাহিনীর সদস্যদের মাঝ থেকে কাকে/ কাদের কোথায় চাকুরি দেওয়া হবে। ইংরেজিতে "ইলেকশন" যাই বুঝাক না কেন, উনারা শব্দটিকে যেমন বুঝেছেন, তেমনি বাংলা হয়েছে।
"কে নির্বাচনে আসবে না আসবে তা আমাদের বিষয় না" কিংবা "আমাদের ছাড়া নির্বাচন হবে না" এই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে কি পরিষ্কার হয়ে ওঠে না যে, ইলেকশন করার যারা কর্তা, অর্থাৎ জনগণ; তারাই এই প্রক্রিয়ার বাইরে। জনগণ বলতে পারে, "কে নির্বাচনে আসবে না আসবে তা আমাদের বিষয় না" কিংবা "আমাদের ছাড়া নির্বাচনই হবে না"। কর্তার ভাষ্য এমন হতে পারে। কিন্তু যারা ইলেকশনে প্রার্থী হবেন, ইলেকটেড হতে চান তারা এমন কথা বলতে পারেন কিভাবে?
কিভাবে পারেন তার উত্তর ইলেকশন শব্দের বাংলা নির্বাচন করার মানস প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বলে আমার অনুমান। এ কারণে আমাদের নেতানেত্রীরা যা করেন সেটিকে তারা "নির্বাচন" বলে মেনে নিতে অন্তরে কোনো দ্বিধা বোধ করেন না। তারা জানেন, তারা নির্বাচনই করেছেন। তারা "নির্বাচন" বোঝেন। "ইলেকশন" বোঝা তাদের দরকারই হয় না। তাই বলি, বরং আমাদের ইলেকশন কমিশনের নাম ইংরেজিতে "সিলেকশন কমিশন" হলে মানুষ কম বিভ্রান্ত হবে। অন্তত ইংরেজি ভাষার লোকজন এখানে "ইলেকশন" খুঁজতে আসবে না।
Ar Raji
Assistant Professor
University Of Chittagong
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Post a Comment